
দিগ্বেশ রাঠি-ফটো কোলাজ
প্রতিটি আইপিএলেই উঠে আসে কিছু নতুন মুখ। যারা পারফরম্যান্স দিয়ে নিজেকে চেনান আলাদাভাবে। এবারের আইপিএলেও এরই মধ্যে বেশ কিছু তরুণ ক্রিকেটার আলোচনায় উঠে এসেছেন। যাদের একজন দিগ্বেশ রাঠি। তাকে নিয়ে আলোচনার বড় কারণ, ভারতের প্রথাগত ঘরানার বাইরে থেকে উঠে এসে আলো ছড়াচ্ছেন এ বোলার।
অন্য ক্রিকেটারদের চাইতে রাঠির গল্পটা একটু বেশিই আলাদা। তিনি যেন বারবার ধাক্কা খেয়েও হার না মানা এক যোদ্ধা। যার লড়াইয়ের অস্ত্র একটিই, কঠোর পরিশ্রম। আর তাই যেন দিল্লির দ্রোণাচার্য ক্রিকেট একাডেমিতে রাঠির কোচ শচীন শুক্লা বলেছেন, কঠোর পরিশ্রম অনেক সময় প্রতিভাকেও হারিয়ে দেয় আর তার সেরা উদাহরণ রাঠি।
এবারের আইপিএলে লখনৌ সুপার জায়ান্টসের হয়ে খেলছেন রাঠি। মিতব্যয়ী বোলিংয়ের পাশাপাশি ব্যতিক্রমী উদযাপনের মাধ্যমে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এই রহস্যময় স্পিনার। এখন পর্যন্ত আট ম্যাচে ৭.৪৩ ইকোনমি রেটে নয় উইকেট নিয়েছেন তিনি। তবে এসব ছাপিয়ে রাঠি আলোচিত কিংবা সমালোচিত তার “নোটবুক” উদযাপনের জন্য। যে কারণে দুবার শাস্তি পেয়েছেন এই ক্রিকেটার।
অনেকটা সুনীল নারাইন অনুপ্রাণিত রান-আপে বল করা রাঠির শুরুটা ছিল চমকে ভরা। ২০১৭ সালে ১৭ বছর বয়সে দিল্লিতে একটি ক্রিকেট একাডেমিতে যান। এ সময় সাধারণ অফস্পিন অ্যাকশনে বোলিং করতেন তিনি। তবে সেই অ্যাকশনেই দিল্লি ব্লুজের হয়ে ১৪ ম্যাচে ৪০টিরও বেশি উইকেট নেন এ বোলার।
ভারতে প্রতিটি ক্ষেত্রেই বয়সভিত্তিক ক্রিকেটকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। আর এখানেই পিছিয়ে পড়েন রাঠি। আগে কোনো বয়সভিত্তিক ক্রিকেট না খেললেও পারফরম্যান্সের জোরে দিল্লির অনূর্ধ্ব-১৯ দলের জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল তাকে। তবে সেই দলে আরও অনেক প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের ভীড় এবং বয়সভিত্তিক পর্যায়ে পরীক্ষিত না থাকায় চূড়ান্ত দলে জায়গা করে নিতে ব্যর্থ হন এ বোলার।
এর কিছুদিন পর আরেকটি বড় ধাক্কা আসে রাঠির জীবনে। একটি ম্যাচে ফিল্ডিং করার সময় তার ডান কলারবোন ভেঙে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এরকম ইনজুরিতে পড়লে খেলা ছেড়ে দেন তরুণরা। কিন্তু এখানেই ব্যতিক্রম রাঠি। সুস্থ হয়ে তিনি পরিশ্রমের মাত্রা দ্বিগুণ করে ফেলেন। একইসময়ে রাঠি বুঝতে পারেন, অফস্পিনার হিসেবে নিজেকে আলাদা করে তুলে ধরা সহজ নয়। আর তাই ২০২০ সালের দিকে রহস্যময় স্পিন অ্যাকশনে অনুশীলন শুরু করেন তিনি।
মূলত সুনীল নারাইনকে গুরু মেনে নিজের বোলিং অ্যাকশনে পরিবর্তন আনেন রাঠি। নিজের ফেসবুক এবং হোয়াটসঅ্যাপের প্রোফাইল ছবি হিসেবে নারিনের ছবি ব্যবহার করতেন তিনি। করোনাভাইরাসের সময়টা রাঠির জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে। কারণ এ সময় বোলিং অ্যাকশনের পাশাপাশি ফিটনেস নিয়ে ভালোভাবে কাজ করার সুযোগ পান তিনি। কোভিডের সময়টায় বাড়ির বারান্দায় একটি ছোট জিম স্থাপন করেন রাঠি।
সেখানে নিজেকে আরো ফিট করার পাশাপাশি নেটে দীর্ঘ সময় ধরে বোলিং করতেন তিনি। দিনে ছয় থেকে সাত ঘন্টা ধরে অবিরাম বল করে যেতেন এ মিস্ট্রি স্পিনার। যার মাধ্যমে ক্যারম বল, গুগলি এবং সিম-আপ ডেলিভারিগুলো আরো শাণিত করেন। কঠোর পরিশ্রমের ফল হিসেবে ২০২২ এবং ২০২৩ আইপিএলে দিল্লি ক্যাপিটালস রাঠিকে নেট বোলার হিসেবে বেছে নেয়। ২০২৪ আইপিএলে একই ভূমিকায় কলকাতা নাইট রাইডার্সের সাথে ছিলেন তিনি। যেখানে নিজের আদর্শ নারাইনের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পেরেছিলেন।
গত বছর বিসিসিআই সিকে নাইডু ট্রফিকে অনূর্ধ্ব-২৩ টুর্নামেন্টের পরিবর্তে অনূর্ধ্ব-২৫ টুর্নামেন্টে পরিণত করে। ফলে রাঠি দিল্লির হয়ে খেলার সুযোগ পান। এরপর দিল্লি প্রিমিয়ার লিগে দশ ম্যাচে ৭.৮২ ইকোনমি রেটে ১৪টি উইকেট নিয়ে ডিপিএলে চতুর্থ সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী হন। এরপরই আইপিএলের মেগা নিলাম থেকে রাঠিকে দলে নেয় লখনৌ সুপার জায়ান্টস। আর অভিষেক আসরেই নিজেকে আলাদাভাবে চিনিয়েছেন এ বোলার।
ভারতে ক্রিকেটাররা সাধারণত অনূর্ধ্ব-১৯, অনূর্ধ্ব-২৩ এরপর রঞ্জি ট্রফির পথ ধরে উপরে উঠে আসে। তবে রাঠি এসব প্রথাগত নিয়মের বাইরে থেকেই উঠে এসেছেন। আর যেভাবে পারফর্ম করে যাচ্ছেন, তাতে সামনে ভারত জাতীয় দলে তাকে দেখা গেলেও অবাক হবেন না কেউই।
লেখক- আসাদুজ্জামান লিটন, ক্রীড়া সাংবাদিক