
চরাঞ্চলের স্কুলগুলোতে সাধারণত দেখা মেলে খোলা প্রাঙ্গণ, ধুলোমাখা মাঠ আর গাছপালা–বিচ্ছিন্ন নির্জনতা। কিন্তু এসব চেনা দৃশ্যের বাইরে গিয়ে ব্যতিক্রমী এক পরিবেশ তৈরির পথে হাঁটছে বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার প্রত্যন্ত চরের মধ্যে অবস্থিত ‘চরদলিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’। সেখানে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে রোপণ করা হয়েছে প্রায় শতাধিক ফলজ গাছ যার প্রতিটিই একটি করে শিক্ষার্থীর দায়িত্বে। স্কুলের চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেনিতে পড়ুয়া প্রত্যেকে আছেন গাছের পরিচর্যার প্রধান দায়িত্বে।
চরাঞ্চলের প্রাকৃতিক বৈরিতার মধ্যেও স্কুলটির শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা একসঙ্গে স্বপ্ন দেখছেন এক টুকরো সবুজে ঘেরা বিদ্যালয়ের। সম্প্রতি তারা মিলিত হয়ে বিদ্যালয় চত্বরে আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, জলপাই, কাঠবাদামসহ নানা জাতের দেশীয় ফলের চারা রোপণ করেন। উদ্দেশ্য—বিদ্যালয়কে সবুজে রাঙানো, শিক্ষার্থীদের গাছের সঙ্গে বন্ধন তৈরি করা এবং খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদায় ভবিষ্যতে ছোট হলেও একটি অবদান রাখা।
এই কর্মসূচির বিশেষ দিক হলো, গাছগুলো কেবল রোপণ করেই থেমে যায়নি কার্যক্রম। বরং শিক্ষার্থীদের মধ্যে গড়ে তোলা হয়েছে মালিকানাবোধ। প্রতিটি শিক্ষার্থীকে একটি করে গাছের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা সেই গাছে নিয়মিত পানি দেবে, আগাছা পরিষ্কার করবে এবং প্রয়োজনে শিক্ষক ও অভিভাবকদের সহায়তায় পরিচর্যা করবে।
এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগে সহযোগিতা করেছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘সৈয়দ শাকিল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’। সংগঠনটির পক্ষ থেকে স্কুলটিতে চারাগুলো সরবরাহ করা হয়।
ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ শাকিল বলেন, “শুধু বইয়ের শিক্ষা নয়, শিশুরা প্রকৃতি ও পরিবেশকে ভালোবাসুক, গাছের বেড়ে ওঠা দেখে বেড়ে উঠুক তারাও- এই চিন্তা থেকেই আমরা স্কুলে উন্নত জাতের ফলজ গাছ উপহার দিয়েছি। এসব গাছে খুব অল্প সময়েই ফল আসবে। সেই ফল শিক্ষার্থীদের পুষ্টির ঘাটতি পূরণেও ভূমিকা রাখবে।”
বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. হাবিবুর রহমান জানান, “আমাদের স্কুলে জায়গা ছিল, কিন্তু চারার ব্যবস্থা করতে পারছিলাম না। সৈয়দ শাকিল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট পাশে এসে দাঁড়ানোয় এখন সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রতিটি গাছের দায়িত্বে একজন করে শিক্ষার্থী থাকায় তারা অনেকটাই আত্মনিয়ন্ত্রণ ও দায়িত্বশীলতার শিক্ষাও পাচ্ছে।”
বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী আফরিন বলে, “আমার গাছটি পেয়ারা। আমি প্রতিদিন পানি দিই। বড় হয়ে যেন এটা বড় গাছ হয়, ফল দেয়, আমি তা চাই।”
চরের এই স্কুলের পরিবেশ এখন শুধুই শিক্ষার জায়গা নয়, এটি হয়ে উঠছে পরিবেশচর্চার একটি ছোট উদ্যান। এই উদ্যোগ যেমন শিক্ষার্থীদের মনে গাছের প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ তৈরি করবে, তেমনি ভবিষ্যতে তাদের প্রকৃতির রক্ষাকর্তা হিসেবেও গড়ে তুলবে।
চরের দূরবর্তী এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এমন উদ্যোগ নিঃসন্দেহে অন্য স্কুলগুলোকে অনুপ্রেরণা দেবে। দেশের প্রতিটি বিদ্যালয়ের আঙিনায় যদি এমন কিছু ফলজ গাছ রোপণ করা যায়, তাহলে শুধু সবুজায়ন নয়, শিশুদের ভেতরেও গড়ে উঠবে প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে আত্মিক বন্ধন যা আগামী প্রজন্মকে আরও দায়িত্ববান ও সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবে।