
একজন গর্ভবতী স্ত্রী বারবার কান পেতে থাকেন—বাইরে কেউ দরজায় কড়া নাড়ছে কি না, দূরে কোথাও স্বামীর পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে কি না? কিন্তু না, কেউ আসে না। সেদিন সন্ধ্যায় তার স্বামী মিছিলে গিয়েছিলেন—দেশের জন্য, মানুষের অধিকারের জন্য। সেই মিছিল থেকে আর ফিরে আসেননি। সন্তান পৃথিবীর আলো দেখার আগেই পিতা শহীদ হয়ে যান গুলিতে। আজ তার সন্তান পৃথিবীতে আছে, কিন্তু সে জানেই না কে ছিল তার বাবা। শুধু একটি পুরনো ছবি, কিছু ব্যানার, আর কিছু কান্না—এই তার উত্তরাধিকার।
একজন মা চুপচাপ বসে থাকেন জানালার ধারে। ছেলে একটু আগে ঘুমিয়েছিল পাশের ঘরে। কিন্তু সেই ঘুম ভাঙেনি আর কখনো। রাত গভীর হলে অজানা কিছু লোক তাকে তুলে নিয়ে যায়—চোখ বেঁধে, মুখ চেপে সকালবেলা ঘরে আলো আসে, চায়ের কাপে ধোঁয়া ওঠে, কিন্তু ছেলের আর দেখা মেলে না। মা থানায় যান, আদালতে ছুটে যান, হাসপাতাল ঘুরেন, মর্গে খোঁজেন—কোথাও কোনো রেকর্ড নেই, কোনো নাম নেই। রাষ্ট্র শুধু তার ছেলেকে নয়, তার অস্তিত্বকেই মুছে দিয়েছে।
একটি ছোট ছেলে প্রতিদিন জেগে উঠে প্রথমেই মাকে জিজ্ঞেস করে—“আমার আব্বু কই?” মা চোখের জল লুকিয়ে বলে—“আব্বু তো দেশের জন্য গিয়েছিল… এখনো ফেরেনি।” সেই ছেলেটি জানে না—তার বাবা গুম হয়েছেন। কবর পর্যন্ত নেই—কোথাও কিছু নেই, শুধু এক বুক শূন্যতা।
এই অসংখ্য না বলা কান্না, এই নিস্তব্ধতার মাঝখান থেকে গড়ে উঠেছে এক আত্মিক সংহতির সংগঠন—“আমরা বিএনপি পরিবার”। এটি কোনো রাজনীতিকদের তৈরি সংগঠন নয়। এটি জন্ম নিয়েছে একেকটি শহীদ পরিবার, একেকটি গুম হয়ে যাওয়া প্রিয়জনের অপেক্ষার ভেতর থেকে। একটি নিঃসঙ্গ মা, একটি বিধবা স্ত্রী, একটি উত্তরহীন শিশুর বুক ফাটা কান্না থেকে—এই সংগঠনের সূচনা।
এই সংগঠন কোনো জেলা কমিটি বানায়নি, প্রেস রিলিজ দেয়নি। তারা গিয়েছে—শহীদের বাড়ির উঠোনে, গুম হওয়া কর্মীর ছোট ছেলেটির পাশে, বিধবা স্ত্রীর দরজায়। তারা অসহায়ের ঘর তুলে দিয়েছে—যেখানে শহীদ কর্মীর একা থাকা বৃদ্ধা মা, স্ত্রী, ছোট্ট বাচ্চারা একটু প্রশান্তিতে থাকতে পারেন। তারা মেয়ে সন্তানকে বিয়ের দিন সাজাতে সাহায্য করেছে—যার বাবা গুম হয়ে আছেন। তারা আইনি সহায়তা দিয়েছে সেইসব পরিবারকে, যারা জানতেন না, মামলার পরবর্তী তারিখ কখন। ছিল না কোনো কর্মসূচি—তাদের ছিল ভালোবাসা। তাদের মুখে কোনো স্লোগান ছিল না—তাদের চোখে ছিল নীরব প্রতিজ্ঞা।
এই সংগঠনের অন্যতম প্রেরণা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি দেশের বাইরে থাকলেও প্রতিটি শহীদ পরিবার, গুম-খুনের শিকার হওয়া মানুষের খবর নিয়মিতভাবে নিয়েছেন, নিচ্ছেন। তিনিই সেই মানুষ, যিনি গভীর রাতে ফোন করে একজন শহীদ কর্মীর স্ত্রীর খোঁজ নেন, জিজ্ঞেস করেন—“মেয়েটার স্কুলে যাওয়ায় কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো? ওষুধ লাগলে আমাকে জানাবেন।” রাজনীতির মাঠে যখন অনেকেই নীরব, তখন তারেক রহমান প্রতিটি নিঃসঙ্গ পরিবারের জন্য হয়ে উঠেছেন এক দৃশ্যমান আশ্রয়।
তারেক রহমানের নির্দেশেই পরিবারগুলোর সবশেষ তথ্য রেকর্ড রাখা হয়, জরুরি প্রয়োজনে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, এবং প্রতি উৎসব, ঈদ, শোক বা জয়—সব কিছুতেই পরিবারগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তিনি বলেন, “গুম হওয়া প্রতিটি সন্তানের নাম একদিন ইতিহাসে থাকবে। কোনো চোখের পানি বৃথা যাবে না।”
এই সংগঠনের আহ্বায়ক আতিকুর রহমান রুমন। তিনি সেই বড় ভাই, যিনি শহীদ বাবার সন্তানকে কোলে তুলে নেন, বিধবা মায়ের মাথায় হাত রাখেন। আতিকুর রহমান রুমন যেন ভালোবাসা দিয়ে গড়ে তোলা একটি প্রতিরোধ। ২০২৪ সালের গণআন্দোলনে যখন একের পর এক শহীদ হচ্ছেন সাধারণ মানুষ তখন আতিকুর রহমান রুমনরা ছুটে গেছেন চট্টগ্রাম, বগুড়া, ময়মনসিংহ, ফেনী,কুমিল্লা, কুষ্টিয়া সহ প্রায় ৪০ অধিক জেলা। যেখানে গুলির শব্দ থেমেছে, সেখানেই তিনি পৌঁছেছেন। তিনি শুধু অর্থ বা আশ্বাস দেননি—তিনি পৌঁছে দিয়েছেন তারেক রহমানের বার্তা, “এই রক্ত বৃথা যাবে না। আপনার সন্তান ইতিহাসের একজন যোদ্ধা।”
এই সংগঠনের কেউ লাইভে আসেন না, সেলফি তোলেন না, ব্যানার নিয়ে দাঁড়ান না। তারা কারো কাছে করুণা চায় না। চায় শহীদদের উত্তরাধিকার। তাদের চাওয়া, গুম হওয়া ভাইটির নাম রাষ্ট্রের খাতায় ফিরুক। প্রতিটি রক্তপাতের দায় কেউ স্বীকার করুক। একজন মা জানুক—তার কান্না বৃথা যায়নি, তারা চায়, গুম হওয়া ভাইটির নাম একদিন ইতিহাসে লেখা হোক।
“আমরা বিএনপি পরিবার” একটি সংগঠনের নাম নয়, এটি একটি আত্মার আন্দোলন। এটি সেইসব পরিবারের সম্মিলিত কান্না, যারা বিশ্বাস করে-“আমরা হারাইনি, আমরা জন্ম দিয়েছি এক নতুন দিনের প্রতিজ্ঞা।” এই সংগঠনের প্রতিটি কান্না একদিন জবাব চাইবে, প্রতিটি ত্যাগ একদিন ইতিহাসে লেখা হবে, এবং সেই ইতিহাসের নিচে লেখা থাকবে-“আমরা বিএনপি পরিবার”-কান্নার ভিতর জন্ম নেওয়া এক প্রতিরোধের নাম।
লেখা: আব্দুল্লাহ আল মিসবাহ
শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ