
পিটার ড্রুরি। ফুটবলের মোটামুটি খোঁজ রাখা প্রত্যেকেই এই ভদ্রলোককে চেনেন। ধারাভাষ্য যে একটা শিল্প হতে পারে, সেটা দারুণভাবে প্রমাণ করেছেন তিনি। ফুটবলের ড্রুরির মতো ক্রিকেটেও ছিলেন একজন। ছিলেন এ কারণেই বলা, তিনি আর পৃথিবীতে নেই। তবে মর্ত্যে না থাকলেও বেঁচে থাকতে যা করে গেছেন, তাতে যেন ‘কীর্তিমানের মৃত্যু নাই’ কথাকেই প্রমাণ করেছেন জোরালোভাবে। তার নাম? রিচি বেনো।
বেনোকে আসলে কয়টি পরিচয়ে পরিচিত করানো সম্ভব? ক্রিকেট ক্যারিয়ারে ছিলেন অলরাউন্ডার। অধিনায়ক হিসেবেও ছিলেন দারুণ। আর ক্রিকেট ছাড়ার পর ধারাভাষ্যকক্ষে নিজেকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, তার ধারেকাছে নেই কেউ। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটার হওয়াই যেখানে সম্মানের, সেখানে তারকা অধিনায়কের পরিচয় ছাপিয়ে তিনি ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে প্রিয় হয়ে আছেন ‘ক্রিকেটের কণ্ঠ’ হিসেবেই।
১৯৩০ সালে ৬ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের পেনরিথে রিচি বেনোর জন্ম। ক্রিকেটটা মিশে ছিল তার রক্তেই। বেনোর বাবা লোউ ছিলেন সম্ভাবনাময় লেগ স্পিনার। এক ম্যাচে ২০ উইকেট নেয়ার কীর্তি আছে তার। দারুণ সম্ভাবনা থাকলেও তিনি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খেলা চালিয়ে যাননি। কারণ? নিউ সাউথ ওয়েলসে শিক্ষকতা করবেন তাই।
নিজে না হলেও ছেলেদের ঠিকই ক্রিকেটার বানিয়েছিলেন লোউ। বড় ছেলে রিচি বেনো তো কিংবদন্তি। তার ১৩ বছরের ছোট জন বেনোও অস্ট্রেলিয়ার হয়ে টেস্ট ক্রিকেট খেলেছেন। ছোট্ট একটা রুমে বড় ছেলেকে ক্রিকেট শেখাতেন লোউ। প্রথমে শিখিয়েছিলেন ডিফেন্স করা। এরপর লেগ স্পিন। অবশ্য ক্রিকেট ক্যারিয়ারের শুরুটা মসৃণ ছিল না তার।
১৯৪৮ সালে নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে বেনোর অভিষেক হয়। সে মৌসুমে ঘরোয়া শিক্ষার কোনো ছাপ রাখতে পারেননি তিনি। বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে করেছিলেন মাত্র ২ রান। বল করার জন্য তাকে ডাকেননি অধিনায়ক। ভিক্টোরিয়ার বিপক্ষে পরের ম্যাচে নাইটওয়াচ ম্যানের ভূমিকায় নেমে করেছিলেন ১৩ রান। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে শুরুর দিকে বেশ কয়েকটি ম্যাচে বল করার সুযোগই পাননি বেনো। ইনজুরিও তাকে পিছিয়ে দেয়।
ক্যারিয়ার জুড়ে মারাত্মক কিছু চোট সহ্য করতে হয়েছে বেনোকে। এর মাঝে গ্রিন টপের অস্ট্রেলিয়ান উইকেটে চোখ ও চোয়ালের ইনজুরি ছিল উল্লেখযোগ্য। স্বাভাবিকভাবেই হতাশা গ্রাস করেছিল তাকে। ক্রিকেট ছেড়ে চাকরি নেন অ্যাকাউন্টেন্সি ফার্মে। সেখানেও সুবিধা করতে পারেননি। সম্ভবত এই কারণেই রিচি বেনোর আত্মজীবনীর একটা অধ্যায়ের নাম ‘প্রমিজিং মাচ বাট ডেলিভারিং লিটল।’
তবে দমে না গিয়ে খেলা চালিয়ে যেতে থাকেন বেনো। ধীরে ধীরে পেতে থাকেন সাফল্যের দেখা। এর মাঝে ১৯৫১ সালে প্রথম সেঞ্চুরির দেখা পান। সেবার উইন্ডিজের বিরুদ্ধে অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দলে ডাক পান। তবে প্রথম টেস্টে বলার মতো কিছু করতে পারেননি। স্যার ফ্রাঙ্ক ওরেলকে রান আউট করেছিলেন। দ্বিতীয় ইনিংসে ৪.৩ ওভার বোলিং করার সুযোগ পেয়ে বোল্ড করেন আলফ্রেড ভ্যালেন্টাইনকে। ব্যাট হাতে দুই ইনিংসে করেন যথাক্রমে ৩ ও ১৯ রান।
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরুর প্রথম কয়েকবছর সেভাবে আলোচনায় ছিলেন না বেনো। তার পারফরম্যান্স এমন ছিল যে ঠিক ম্যাচ উইনার নন, আবার নির্বাচকরা বাদও দিতে পারছিলেন না। অবশেষে ১৯৫৬ সালের ভারত সফরে নিজেকে আলাদাভাবে চেনান এ অলরাউন্ডার। মাদ্রাজে (বর্তমান চেন্নাই) ৮ উইকেট নিয়ে নতুন পথচলার শুরু। পরের টেস্ট বোম্বেতে (বর্তমান মুম্বাই), সেখানে আবার মলিন। কিন্তু ইডেনে এসে দুই ইনিংস মিলিয়ে নিলেন ১১ উইকেট।
কলকাতায় প্রথম ইনিংসে ১৭৭ করা অস্ট্রেলিয়া বেনোর বোলিং তাণ্ডবে পায় বড় জয়। তার তারকা হয়ে ওঠার গল্পের শুরুটা সেখানেই। এরপর ১৯৫৭-৫৮ মৌসুমে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে ভাল খেলার সুবাদে ঘরের মাঠে ১৯৫৮-এর অ্যাশেজে হলেন অধিনায়ক। সেখানেও ছিলেন দারুণ সফল। ১৯৬০-৬১ মৌসুমে স্যার ফ্রাঙ্ক ওরেলের ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেই সিরিজ নিয়ে তো এখনো আলোচনা হয়।
অধিনায়ক হিসেবে টানা দুইবার অ্যাশেজ জিতে ডন ব্র্যাডম্যান পরবর্তী অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে দ্রুতই নতুন তারকা হয়ে ওঠেন বেনো। লেগ স্পিনার হিসেবে সেই জয়ে বড় ভূমিকা ছিল তারই। এর মাঝে ১৯৬১ সালের ইংল্যান্ড সফরে লেগ স্পিন বোলিংয়ের ভাবনাই বদলে দেন। সেবার প্রথম টেস্ট ড্র হয়, পরের ম্যাচে জয় পায় অস্ট্রেলিয়া। চতুর্থ টেস্টের ভেন্যু ম্যানচেস্টার।
ফ্রেড ট্রুম্যান-স্টেথামের দুর্ধর্ষ বোলিংয়ের সামনে অস্ট্রেলিয়ার ইনিংস গুটিয়ে যায় ১৯০ তে। জবাবে পিটার মের ৯৫ এর উপর ভর করে ইংল্যান্ড করে ৩৬৭। এই ইনিংসে কোনো উইকেট পাননি বেনো। দ্বিতীয় ইনিংসে অবশ্য অস্ট্রেলিয়া ঘুরে দাঁড়ায়। বিল লরির সেঞ্চুরি, অ্যালান ডেভিডসনের ৭৭ ও শেষে ব্যাট করতে নেমে গ্রাহাম ম্যাকেঞ্জির ৩২ রানের বদৌলতে ইংলিশদের লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়ায় ২৫৬।
ইংল্যান্ড যখন ব্যাট করতে নামবে তখন শেষ দিনে খেলা বাকি চার ঘন্টার কাছাকাছি সময়। বেশির ভাগ দর্শক ধরেই নিয়েছিলেন ম্যাচ ড্র হতে চলেছে। কিন্তু টেড ডেক্সটারের মাথায় ছিল অন্য কিছু। তিনি যে রকম অগ্নিমূর্তি ধারণ করেছিলেন, তাতে ইংল্যান্ড সময় শেষের আগেই জিতে যাবে এমনটা মনে হচ্ছিল। এরপরই বেনো নিয়ে লেগস্পিন বদলে দেওয়া সেই ঘটনা। রানের জোয়ার বন্ধ করতে বল শুরু করলেন রাউন্ড দ্য উইকেটে এসে।
লেগস্পিনাররা সে সময় সাধারণত রান আটকানোর জন্য রাউন্ড দ্য উইকেটে বোলিং করতে আসেন। কিন্তু বেনো নিজেও হয়তো ভাবেননি স্বাগতিক দলের ফ্ল্যাভেল, ট্রুম্যান, ম্যাকেঞ্জিদের তৈরি করা ফুটমার্ক তাকে কয়েক ঘন্টার মধ্যে ইতিহাস বদলে দেওয়া ক্রিকেটারে পরিণত করবে। শুরুতে ডেক্সটারকেই ফেরান বেনো। এরপর তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে ইংল্যান্ডের প্রতিরোধ।
সেই ইনিংস বেনো শেষ করেন ৬ উইকেট নিয়ে, ইংল্যান্ড ম্যাচ হারে ৫৪ রানে। সেই প্রথম ক্রিকেট বিশ্ব বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখলো, লেগস্পিনার রাউন্ড দ্য উইকেট এসে রান আটকানো ছাড়াও উইকেট তুলতে পারে। বেনো অধিনায়ক হিসেবে কেমন ছিলেন তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ, ২৮টি টেস্টে নেতৃত্ব দিয়ে একবারও সিরিজ হারেননি। ৬৩ টেস্টে ২৪৮ উইকেটের সঙ্গে ২,২০১ রান ক্রিকেটার হিসেবে তার অলরাউন্ডার সত্ত্বারই প্রমাণ।
টেস্ট ক্রিকেটে ২০০ উইকেট নেয়ার পাশাপাশি দুই হাজার রান করা প্রথম ক্রিকেটার বেনো। ব্যাট হাতে তার ক্যারিয়ার ২৪.৪৫, এর মধ্যে সেঞ্চুরি আছে ৩টি ও অর্ধশতক ৯টি। বোলিং গড় ২৭.০৩। ক্যারিয়ারে ৫ উইকেট নিয়েছেন ১৬ বার। ১০ উইকেট নিয়েছেন ১ বার। টেস্টে সর্বোচ্চ স্কোর ১২২ রান। সেরা বোলিং সাফল্য ৭২ রানে ৭ উইকেট। ক্যাচ নিয়েছেন ৬৫টি।
মাঠের ক্রিকেট থেকে অবসর নেয়ার পর বেনো নতুন শুরু করেন কলম হাতে, সাংবাদিক হিসেবে। তবে ক্রিকেট তাকে বেশি মনে রেখেছে ধারাভাষ্যকার হিসেবেই। যেখানে মাইক্রোফোন হাতে স্বাক্ষর রেখে গেছেন নিজের ক্রিকেট জ্ঞানের। কমেন্ট্রি যে একটি আলাদা শিল্প, তার প্রমাণ তিনি দিয়েছেন প্রতিটি শব্দ, বাক্য আর বর্ণনায়। আর তাই তাকে ডাকা হতো মাস্টার অব দ্য মাইক্রোফোন নামে।
প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ার শেষ করার আগেই ডেইলি সানে কাজ শুরু করেন বেনো। ১৯৬০ সালে বিবিসির হয়ে রেডিওতে ধারাভাষ্য দেওয়ার তিন বছর পর টেলিভেশনে শুরু করেন কমেন্ট্রি। কথা বলার ভঙ্গি, বর্ণনা ভাষা, রসবোধ আর ক্রিকেট জ্ঞানে দর্শকদের যুগের পর যুগ মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছেন তিনি। চ্যানেল নাইন, বিবিসি থেকে শুরু করে চ্যানেল ফোর- যেখানেই ক্রিকেট, সেখানেই রিচি বেনোর কমেন্ট্রি হয়ে উঠেছিল নিয়ম।
রিচি বেনোর ধারাভাষ্য অন্যতম জনপ্রিয় উচ্চারণ ছিল তার Two উচ্চারণটি। বাকিদের থেকে একটু অন্যভাবে তিনি Two উচ্চারণ করতেন। বিশেষ করে ২২২ রানকে রিচি বেনোর ‘two for two, two, two’ উচ্চারণ ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে ছিল অন্যরকম প্রিয়। শেন ওয়ার্ন যখন শতাব্দীর সেরা বলে মাইক গ্যাটিংকে আউট করেন, সেই সময় কমেন্ট্রি বক্সে বসে থাকা বেনো বলেন, গ্যাটিংয়ের কোনো ধারণা নেই কী হয়েছে। ও এখনো জানে না। ও আম্পায়ার কেনি পালমারকে জিজ্ঞাসা করছে। কেনি পালমার নিজের ভ্রু তুলে শুধু মাথা নেড়েছেন।
ট্রেভর চ্যাপেলের ঐতিহাসিক আন্ডার আর্ম ডেলিভারির মুহূর্ত ক্রিকেটের কণ্ঠ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠা বেনোর ধারাভাষ্য ক্যারিয়ারের আরো একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। যা একইসঙ্গে বিতর্কিতও। গ্রেগ চ্যাপেলের ভাই ট্রেভর চ্যাপেলের সেই বলের জন্য জেতা ম্যাচ হেরে যায় নিউজিল্যান্ড। সেই সময় রিচি বেনো বলে ওঠেন, অধিনায়কের পক্ষ থেকে একটা বাজে পারফরম্যান্স। এটা আর হতে দেওয়া যবে না। আমি ক্রিকেট মাঠে ঘটা সবচেয়ে জঘন্য জিনিস দেখলাম।
সিম্পলি মার্ভেলাস, ওয়ান্ডারফুল শব্দগুলোকে ক্রিকেটের অভিধানে ঢুকিয়ে ধারাভাষ্যকে আলাদা উচ্চতা দেন বেনো। তিনি ক্রিকেটবিশ্বে আলাদাভাবে প্রিয় হয়ে ওঠেন ১৯৭৭ সালে ক্যারি প্যাকার সিরিজের সময়। ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেটের সৃষ্টিশীল ধারণা বেরিয়েছিল তার মাথা থেকেই। যা পরে ক্রিকেটের বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনায় রাখে বড় ভূমিকা। দীর্ঘ ৫০ বছর ধারাভাষ্যকার হিসেবে কাজ করা এ কিংবদন্তি ২০১৫ সালের ১০ এপ্রিল পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন।
অবশ্য বছর দুয়েক আগে একটি দুর্ঘটনার পর থেকেই ভুগছিলেন বেনো। শরীরে বাসা বেঁধেছিল মরণঘাতী ক্যান্সারও। তার প্রয়াণে শোকে স্তব্ধ হয়ে যায় পুরো ক্রিকেট দুনিয়া। বেনোর বিদায়ে অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ধারাভাষ্যকার জিম ম্যাক্সওয়েল বলেছিলেন, ‘যদি ক্রিকেট কখনো পোপ নিযুক্ত করত, তাহলে সেই সম্মান পেতেন রিচি বেনো। গত ৫০ বছরে তিনিই এ খেলার সবচেয়ে প্রভাবশালী, শ্রদ্ধেয় ও সম্মানজনক ব্যক্তিত্ব।’
বেনোকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়কালে সবচেয়ে প্রভাববিস্তারকারী ক্রিকেটার ও ক্রিকেট ব্যক্তিত্বরূপে বর্ণনা করেছেন গিডিওন হেই। আইসিসি ও অস্ট্রেলিয়ার হল অব ফেমে আছে বেনোর নাম। অস্ট্রেলিয়ার মুদ্রায় আছে তার প্রতিকৃতি। স্টেডিয়ামে তার নামে আছে বিশেষ স্ট্যান্ড। বেনো না থাকলেও তার কীর্তিগুলো রয়ে গেছে ক্রিকেটপ্রেমীদের হৃদয়ের মণিকোঠায়। আর ‘দ্য মাস্টার অফ দ্য মাইক্রোফোন’ হিসেবে সেটা চিরকাল থাকবে অমলিন।
লেখক-আসাদুজ্জামান লিটন, ক্রীড়া সাংবাদিক